“ইসরাইল ইহার সকল নাগরিকদের জন্য একটি দেশ নয়। বরং এটি ইহুদি এবং কেবলমাত্র ইহুদিদের জন্যই একটি জাতি-রাষ্ট্র।” – বেনজামিন নেতানিয়াহু।গণতন্ত্র, জনগণের পছন্দে নির্বাচিত একটি শাসনব্যবস্থা, সকল নাগরিকের সমান অধিকারের উপর প্রতিষ্ঠিত। স্বভাবতই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অনাগরিক ও নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ইসরাইল নিম্নোক্তক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য সৃষ্টি করে:
১) ইহুদি অনাগরিক ও অনিহুদি(কিংবা ফিলিস্তিনি) অনাগরিকদের মধ্যে:
- ইসরাইলের “প্রত্যাবর্তন আইন” ও “নাগরিকত্ব আইন”, আবাস ও নাগরিকত্ব প্রদানে অনিহুদিদের তুলনায় ইহুদিদের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করে।
- “অনুপস্থিত সম্পত্তি আইন”, ও “জমি অধিগ্রহণ আইন” ও “ভূমি অধ্যাদেশ(পাবলিক ব্যবহারে অধিগ্রহণ)”আইন সংশোধন ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের অনিহুদিদের ভূমি দখল জারি করেছে (যাদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করে প্রত্যাবর্তন অধিকার ও ইসরাইলি নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে)।
- ইসরাইল একজন “ইহুদি” কে তার কোনো সংজ্ঞা প্রদান করে না, এটি “ধর্মান্তর স্বীকৃতি” নামক এমন একটি ব্যবস্থা জারি করেছে যা ইহুদিধর্মে বিশ্বাসী “স্বীকৃত ইহুদি” এবং ইহুদিধর্মে বিশ্বাসী “অস্বীকৃত ইহুদি”দের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে।
২) ইহুদি নাগরিক ও অনিহুদি নাগরিকদের মধ্যে:
- আইনগত পৃথকীকরণ:
- “মৌলিক আইন” ইসরাইলের ভূ-খণ্ডের উপর অনিহুদিদের অধিকারের বিষয়টি বাদ দিয়ে ভূ-খণ্ডটিকে শুধু ইহুদিদের ঐতিহাসিক জন্মভূমি বলে ঘোষণা করে এবং উল্লেখ করে যে “ইসরাইল রাষ্ট্রে জাতিগত আত্মসংকল্পের অধিকার বাস্তবায়ন কেবলমাত্র ইহুদিদের জন্যই”। রাষ্ট্রের প্রতীক হচ্ছে ইহুদিদের একটি ধর্মীয় চিহ্ন।
- ইসরাইল একজন ব্যক্তির নাগরিকত্ব(ইসরাইলি) ও জাতীয়তা(ইহুদি, আরব, ড্রুজ প্রভৃতি – এগুলো তাদের সরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা সংজ্ঞায়িত, ব্যক্তি দ্বারা নয়) এর মধ্যে পার্থক্য করে, যা নিম্নোক্ত পৃথকীকরণ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে।
- সুপ্রিম কোর্ট জারি করেছে যে ইসরাইলের “প্রতিষ্ঠার মূলনীতি হলো ইহুদি জনতার জন্য একটি ইহুদি রাষ্ট্র হয়ে কাজ করা”।
- সুপ্রিম কোর্ট একটি ইসরাইলি জাতীয়তার পিটিশন প্রত্যাখ্যান করেছে কারণ এটা “ইসরাইলের ইহুদিত্ব হ্রাস করবে”।
- যেসকলনাগরিক ইহুদি রাষ্ট্র থেকে সকলের জন্য একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রুপান্তরের প্রস্তাব দেন, ইসরাইল তাদের উপর আইন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
- অনিহুদি নাগরিকদের উপর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হামলা চালানো বা হত্যার অপরাধকে উপেক্ষা করা।
- জমি বরাদ্দকরণ ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে পৃথকীকরণ:
- বৈষম্যমূলক ভূমিপ্রশাসন নীতি; ১৯৪৮ সালে বেশিরভাগ দখলকৃত জমির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ‘জুয়িশ ন্যাশনাল ফান্ড’ এর উপর, যাদের পরিকল্পনা হচ্ছে “ইসরাইলে ইহুদি জনগণের জন্য ভস্মভূমি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা”।
- অনিহুদি পৌরসভাসমূহ দেশের ২০% জনসংখ্যা হলেও তাদের অধিকারক্ষেত্র ভূমির মাত্র ২.৫%
- “এডমিশনস কমিটি” দেশে ৭০০টির বেশি কৃষিকাজ সংক্রান্ত পাড়া-মহল্লায় তদারকি করে অনিহুদি প্রার্থীদেরকে তাদের খামখেয়ালি সংজ্ঞানুযায়ী “সামাজিকভাবে অনুপযুক্ত” অভিযোগে বাতিল করে দিচ্ছে।
- শিক্ষাব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ:
- শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইহুদি ও অনিহুদিদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পাঠ্যক্রম প্রণিত করেছে।
- পাঠ্যক্রম অব্যাহতি কেবলমাত্র ইহুদি বিদ্যালয়দেরকে প্রদান করা হয়, এবং শুধু ইহুদি বিদ্যালয়গুলোই রাষ্ট্র কর্তৃক অর্থায়িত।
- পাঠ্যক্রম (যা অনিহুদিদের উপরও প্রযোজ্য) জোরপূর্বক ইহুদিবাদ ও ইহুদি মূল্যবোধের উপর কেন্দ্র করে এবং নাগরিক বিজ্ঞান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুরোপুরি বাদ দেয়।
- ইহুদিদের আরবি শিক্ষা ও অনিহুদিদের হিব্রু শিক্ষায় ভাষাগত বৈষম্য।
- আরবি শিক্ষার ক্ষেত্রে অনারব শিক্ষকদের উপর নির্ভরশীলতা।
- শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে শিক্ষক নিয়োগ থেকে আরব শিক্ষকদেরকে বাতিল করে দেয়, ফলে আরব শিক্ষকদের মধ্যে তিন ভাগের মাত্র এক ভাগ চাকরিতে নিযুক্ত হতে সক্ষম।
- অনিহুদিদেরকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও অধিকার দেওয়া হয়নি।
- রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সামাজিক কল্যাণের বৈষম্যমূলক বণ্টন:
- কর আরোপ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ বরাদ্দকরণের ক্ষেত্রে কোনো সুস্পষ্ট ও ন্যায্য মানদণ্ড নেই।
- জেরুজালেম ওঅন্যান্য শহরের মধ্যে বৈষম্যমূলক বাজেট ও সরকারি প্ল্যানিং।
- দাপ্তরিক কাজে আরবি ভাষাকে হিব্রু ভাষার তুলনায় ব্যাপকভাবে নিম্নদৃষ্টিতে দেখা হয়, আরবি ভাষাকে খুব সাম্প্রতিককালেই সরকারি ভাষার উপাধি থেকে বাতিল করা হয়েছে।
- ইচ্ছাকৃতভাবে ইহুদি নাগরিকদের জন্য উন্নয়নমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন এবং “অপরদিকে আরবদের”জন্য উন্নয়নমূলক কর্মসূচি প্রণয়নে মন্থরতা ও ব্যর্থতা, যা নিম্নোক্ত আর্থ-সামাজিক বিভাজন সৃষ্টির জন্য দায়ী:
- আয় ব্যবধান: গড় হিসাবে, কর্মরত অনিহুদিদের আয়ের পরিমাণ একই ক্ষেত্রে কর্মরত ইহুদিদের আয়ের মাত্র ৫৮.৬%।
- দারিদ্র্য ব্যবধান: ৩৫.৮% আরব জনগণ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে।(জাতীয় গড় দারিদ্র্য হার ২৩% এর সাথে তুলনা করলেই বোঝা যায় যে এটি জাতিগত বৈষম্যের ফলাফল)
- শিক্ষা ব্যবধান: বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত ইহুদি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনিহুদি শিক্ষার্থীদের তুলনায় দ্বিগুণ।
৩)আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলে সংযুক্ত অঞ্চলে ইহুদি ও অনিহুদিদের মধ্যে:
- পূর্ব জেরুজালেমে এটি:
- অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনার পরিমাণ বৃদ্ধি করে যাচ্ছে।
- স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনিহুদিদেরকে নির্মাণের অনুমোদন থেকে বঞ্চিত করছে।
- অনিহুদিদের বাড়িঘর ভেঙে স্থানত্যাগে বাধ্য এবং ক্রমান্বয়ে তাদেরকে ক্ষুদ্রতর ,ও ঘনবসতিপূর্ণ ছিটমহলে বসবাসে বাধ্য করছে।
- অনিহুদি এলাকাগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, গণপরিবহন, বিদ্যুৎ সংযোগ, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মতো অতিপ্রয়োজনীয় সেবা প্রদান বন্ধ করেছে।
- গোলান মালভূমিতে এটি:
- অনিহুদি বাসিন্দাদের পূর্ববর্তী ভিন্ন নাগরিকত্বকে স্বীকৃতি দেয় না।
- অনিহুদি বাসিন্দাদের ৯৫% জমি বাজেয়াপ্ত করেছে।
- “জুয়িশ এজেন্সি ফর ইসরাইল” (যার পূর্বনাম ছিল “জুয়িশ এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন”) এর ক্ষমতায় অকার্যকর জোনিং ও বিল্ডিং কোড জারি করে, যাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ইহুদিদের স্বার্থে কাজ করা।
- ওয়ার্ল্ড জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশন এর নামে বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিকল্পনা পরিষদ গড়ে তুলেছে,যাদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ইহুদিদের স্বার্থে এগিয়ে চলা।
- বিদ্যুৎ ও পানির মতো মৌলিক চাহিদা পূরণেও ইহুদি ও অনিহুদির মধ্যে বৈষম্য করে।
৪)পশ্চিম তীরের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত না করলেও সামরিক দখলের অধীনস্থ অঞ্চলে ইহুদি ও অনিহুদিদের মধ্যে এটি:
- ইহুদিদের আবাসন নিশ্চিত করে অনিহুদিদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে।
- পশ্চিম তীর থেকে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে এমন অনিহুদিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অধিকার লঙ্ঘন করে এবং ইহুদিদের আবাসন বৃদ্ধি করছে।
- বিভিন্ন রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে সামরিক চেকপয়েন্ট ব্যবস্থায় স্বাধীনভাবে চলাচল দুর্গম করেছে, ইহুদি বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে আবার এটি কোনো রকম সমস্যা সৃষ্টি করে না।
- অনিহুদিদের জমি দখল করে ইহুদিদের জন্য বাড়িঘর নির্মাণের পরিমাণ বাড়িয়ে চলছে।
- অনিহুদিদেরকে প্রায় কখনোই বিল্ডিং অনুমোদন প্রদান করে না।
- ইহুদি ও অনিহুদিদের মধ্যে বৈষম্যকারক প্লানিং নীতি প্রণয়ন করে চলছে।
- সামরিকভাবে সংযুক্ত অঞ্চলে ইসরাইল বৈবাহিক সম্পর্কের অনিহুদিদেরকে আইনি স্বীকৃতি প্রদান করেনা, এককথায় তাদের পারিবারিক একীকরণের অধিকার লঙ্ঘন করছে।
- স্থানীয় অনিহুদির সাথে প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ কোনো বৈদেশিক যদি পশ্চিম তীরে পরিদর্শন/বসবাসের অনুমোদন নিতে চান তাহলে কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি উক্ত সম্পর্ক প্রকাশ করতে বাধ্য। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, এরূপ কোনো সম্পর্ক স্বীকার করলে বৈদেশিকগণ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা, স্বেচ্ছাসেবা, শিক্ষকতার অনুমোদন থেকে নিষিদ্ধ তালিকাভুক্ত হয়ে যান। এজাতীয় কোনো কিছুই পশ্চিম তীরের ইহুদিদের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ বৈদেশিকদের উপর প্রযোজ্য নয়।
- অনিহুদির বিরুদ্ধে ইহুদি বাসিন্দাদের সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয় এবং অনিহুদিদের বিরুদ্ধে অমানবিক ও মাত্রাতিরিক্ত জোর প্রয়োগ করে।
- উক্ত সবকিছু এই ভূমিতে অপরিবর্তনীয়ভাবে উপনিবেশ স্থাপনের উদ্দেশ্যে চালিয়ে যাচ্ছে, আরিয়েল শারনের কথায়।
৫) ইহার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ইহুদি ও অনিহুদিদের মধ্যে:যেমন- বহু দশকের পরিচয়বাদী সামরিক দখল শেষে গাজা স্ট্রিপে অবরোধ জারি করার পূর্বে শুধুমাত্র ইহুদি বাসিন্দাদেরকে স্থানত্যাগের সুবিধা প্রদান এবং উপরিউক্ত বর্ণনানুযায়ী বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা।